নিউজ ডেস্ক।।
আজ ১৪ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের সাংবাদিক লিয়াকত আলী মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন।
উপাচার্য বলেন, পাকিস্তানিরা যখনই বুঝতে পারে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, কোনোভাবেই দাবিয়ে রাখা যাবে না, তখন থেকেই জাতির সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়, যা স্বাধীনতার পরেও অব্যাহত ছিলো। কয়েকবছর আগেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. এস তাহের আহমেদসহ ৩ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কিছুদিন আগে এই বিজয়ের মাসে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বহনকারী বাসে হামলা চালানো হয়- এসবই একই সূত্রে গাঁথা বলে আমি মনে করি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আগেও যেমন নৃশংসতা চালিয়েছে, এখনও সুযোগ পেলে তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে নতুন প্রজন্মকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে একটি দেশ ও জাতিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এসব হত্যাকারীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। দেশকে উল্টোপথে পরিচালিত করেছে। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি গাড়িতে জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরেছে। আজও তাদের দোসররা নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এদেরকে মোকাবেলা করতে বঙ্গবন্ধু যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন, সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সবাইকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশ যে অগ্রগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, অমিত সম্ভাবনার এই বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তাহলে দেশ অচিরেই সুখী-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হবে।
আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মোসাম্মাৎ হোসনে আরা। তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা বাংলাদেশের উত্থান রুখতে এবং জাতিকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। স্বাধীনতার পরেও তাদের দোসররা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বহনকারী একটি বাসে হামলা করা হয়েছে। এটিও একটি চক্রান্ত। এসব অপশক্তি প্রতিহত করতে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নির্মমতা তুলে ধরতে হবে।
সভায় মুখ্য আলোচক হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যা, দেশ-বিভাগ, স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর অমিত রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশ বিভাগের সময় যারা পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা বাংলাদেশ সৃষ্টির নেপথ্য নায়ক হতে পারেন সেই সব বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর সাথে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে হত্যা এবং মা-বোনদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দিক থেকে পেছন দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেশ বিভাগের পর এই বিজয়ের সুফল বাঙালিরা তথা পূর্ব পাকিস্তানিরা কখনোই পায়নি। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের প্রথম আঘাত ছিলো বাংলা ভাষার প্রতি আঘাত। যারা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মানেন নি, তারাই বাংলা ভাষা নিয়ে অপপ্রচার করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় কারা এগিয়ে, কারা একটা সমাজকে প্রভাবিত করতে পারেন, কারা সভ্যতা এগিয়ে নিতে পারেন- তাদের চিহ্নিত করে হত্যা করেছে। তারা পাকিস্তানের শত্রু এটা ভেবেই নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের প্রাণনাশ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরও এই হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ছিলো।
মুখ্য আলোচক বলেন, পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধকালে একদিকে টর্চার সেল করেছে, অন্যদিকে করেছে রেপ সেল। সারা পৃথিবীতে যেখানে বিজয়ীরা ইতিহাস লেখে, সেখানে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। পরাজিতদের পক্ষে এখনো এদেশে আওয়াজ ওঠে। পাকিস্তানের জন্য পতাকা ওড়ে। বাংলাদেশের সাথে যখন পাকিস্তানের খেলা হয়, তখনও দেখা যায় বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন। আজকের এই নতুন প্রজন্মকে পাকিস্তানের বিভৎসতা, নৃশংসতা, ভয়াবহতা জানতে দেইনি, শুধুমাত্র আত্মদ্বন্দ্বের কারণে। সবচেয়ে বড় সত্য, বাংলাদেশ হয়েছে বলেই আমরা আজ এই অবস্থানে আছি। আজ পাকিস্তানের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, তারা কোন অবস্থায় আছে, আমরা কোন অবস্থায় আছি। একটা দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে তাকে সৎ, সত্যনিষ্ঠ, ইতিহাস সচেতন এবং বিজ্ঞান মনষ্ক হতে হবে।
দিবসের শুরুতে সকাল ৯টায় শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ ভবনের সম্মুখে কালোব্যাজ ধারণ এবং সকাল ৯টা ১০ মিনিটে উপাচার্য কর্তৃক জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও উপ-উপাচার্য কর্তৃক কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে উপাচার্যের নেতৃত্বে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের প্রাক্কালে শহিদ তাজউদ্দিন আহমদ প্রশাসন ভবনের সামনে থেকে একটি র্যালি শুরু হয়ে অদম্য বাংলা চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দোয়া মাহফিল, বেলা ১২টা ৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় মন্দিরে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। দিবসের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্য রয়েছে- সন্ধ্যা ৫.৩০ মিনিটে শহিদ মিনার ও অদম্য বাংলায় প্রদীপ প্রজ্বালন।