এল হিজরি নববর্ষ ১৪৪৬ সন। ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সন আরবি তারিখ ও চান্দ্রমাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুনিক ঐতিহ্য সম্পৃক্ত।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) যখন খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন বহু দূরদূরান্ত পর্যন্ত নতুন নতুন রাষ্ট্র ও ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐতিহাসিক আল বেরুনি বিধৃত বিবরণী হলো, হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) একটি পত্রে উমর (রা.)-এর কাছে অভিযোগ করেন, আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠি পাঠাচ্ছেন, সেগুলোতে সন-তারিখের উল্লেখ নেই, এতে আমাদের অসুবিধা হয়। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে খলিফা হজরত উমর (রা.) একটি সন চালুর ব্যাপারে সচেষ্ট হন। আল্লামা শিবলি নোমানি (রা.) হিজরি সনের প্রচলন সম্পর্কে তাঁর সুপ্রসিদ্ধ আল ফারুক গ্রন্থে উল্লেখ করেন: হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনের শাবান মাসে খলিফা উমরের কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সনের উল্লেখ ছিল না। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা জিজ্ঞাসা করেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে এটি কোন সনে পেশ করা হয়েছিল? অতঃপর তিনি সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য শীর্ষপর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা মুতাবিক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)। পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ শুরু (হিজরি সনের শুরু) করার পরামর্শ প্রদান করেন হজরত উসমান (রা.)। (বুখারি ও আবু দাউদ)।
হিজরি সন তথা ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাস এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য স্মৃতিবিজড়িত, যে স্মৃতিসমূহের সম্মানার্থেই এই মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কালামে রয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারো, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)। এ চার মাসের বৈশিষ্ট্য হলো, যারা বিশেষভাবে এ মাসগুলোতে ইবাদত-বন্দেগি করবে, আল্লাহ তাআলা তাদের বাকি আট মাস ইবাদত করার তৌফিক দান করবেন এবং যারা এ চার মাস নিজেকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন, তাদের জন্য বাকি আট মাস যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হবে। হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের বারো মাসের মধ্যে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে ‘অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস’ বলতে জিলকদ, জিলহজ, মহররম, রজব—এই চার মাসকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি)।
আশুরাতেই নভোমণ্ডলের সৃষ্টিকুলের প্রাথমিক বিভাজনপ্রক্রিয়ার সূচনা হয়। হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও অবনমন—সব ঘটনাই ঘটেছিল আশুরায়। হজরত নূহ (আ.)-এর নৌযানের যাত্রারম্ভ এবং বন্যাবস্থার সমাপ্তি আশুরাকেন্দ্রিক ছিল। হজরত মুসা (আ.)-এর সমুদ্রপথের রওনা ও এর তাওয়াক্কুল যাত্রায় যে সময় বেছে নেওয়া হয়েছিল, তা ছিল আশুরা। এ ধারাবাহিকতায় আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা আশুরার সময়ে বা আশুরাকেন্দ্রিক হতে পারে বলে আশা ও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এ সময় এলেই তিনি বিনম্র থাকতেন, রোজা রাখতেন। (তাফসিরে তাবারি, ইবনে জারির)। আমিরুল মোমেনিন হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর জামানায় সাহাবায়ে কিরামের পরামর্শেই এই মাসকে প্রথম মাস ধরে হিজরি সন গণনা শুরু হয়।